সিটি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক সিজনের কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ
ছবি: সংগৃহীত
পেশায় তিনি একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। কিন্তু তার হাতে যেন ছিল ‘আলাদিনের চেরাগ’। সিটি ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনের এই সাধারণ কর্মকর্তা মাত্র কয়েক বছরে ঢাকার আফতাবনগরে কিনেছেন ফ্ল্যাট; সেখানে আছে নিজের প্লটও। চলেন অর্ধকোটি টাকার দামের টয়োটা হ্যারিয়ার গাড়িতে।
বিগত সরকারের আমলে মন্ত্রী, পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছিল তার নিয়মিত ওঠাবসা। অভিযোগ আছে, সাবেক মন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, তাজুল ইসলাম, পুলিশ মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী, বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম, ডিআইজি আব্দুল বাতেন, ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, ডিআইজি বেলালুর রহমান, কৃষ্ণ পদ রায়সহ পুলিশের সাবেক উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তা এবং মন্ত্রীদের অবৈধ অর্থ লেনদেন ও পাচারেও যুক্ত ছিলেন সিটি ব্যাংকের বনানী শাখার ব্যবস্থাপক মোতাসিম বিল্লাহ সিজন।
অতি সম্প্রতি বনানী শাখার এক নারী সহকর্মীর সঙ্গে তিনি চরম দুর্ব্যবহার করেন। ব্যাংকের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সেই সহকর্মীর ওপর সিজন এতটাই রাগান্বিত ও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন যে তা অন্য সহকর্মীদের মনে দারুণ মর্মপীড়া সৃষ্টি করে। ঘটনাটি এতটাই দৃষ্টিকটু ছিল যে শেষ রক্ষা হয়নি সিজনের। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলে তিনি উল্টো বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পদত্যাগ করেন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিনের প্রশ্রয়ে গত ৭–৮ বছরে রীতিমতো দানবে পরিণত হন এই কর্মকর্তা। তার বেপরোয়া আচরণের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন তরুণ-প্রবীণ অনেক সহকর্মী। এমডির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে সিজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলেও তা নিষ্ফল হবে, সিটি ব্যাংকের সর্বত্র এটি ছিল ওপেন সিক্রেট।
কথিত আছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এমডির নানা ঘটনা ধামাচাপা দিতেই এই বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক সমন্বয় করতেন সিজন। বিশেষ করে ২০১৯ সালে মাসরুর আরেফিনের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় আলোচিত ধর্ষণ মামলা করেন সহকর্মী পপি। সিজনের পুলিশি যোগাযোগের কারণেই মামলা থেকে রেহাই পান এমডি মাসরুর—এমন অভিযোগও রয়েছে। বিনিময়ে তৎকালীন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার আত্মীয়-স্বজনকে সিটি ব্যাংকে চাকরি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, এমডির ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার পুরস্কার হিসেবে সিজন এক বছরে দুটি প্রমোশন পান। ২০২১–২২ সালে লোনের সেলস টিম লিডার থেকে ব্রাঞ্চ ব্যাংকিংয়ে বদলি হন। একই বছর জুলাইয়ে তিনি ব্রাঞ্চ থেকে আরও একটি প্রমোশন পেয়ে ভিপি পদে যোগ দেন। ব্যাংকের জন্য বিশেষ কোনো অবদান না রেখেই শুধুমাত্র এমডির কৃপায় এসব প্রমোশন পেয়েছিলেন—এমন অভিযোগ রয়েছে।
এরপর বনানী শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেন। যার সর্বশেষ পরিণতি—বনানী শাখায় নারী সহকর্মীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং কর্তৃপক্ষের শোকজ খেয়ে তড়িঘড়ি চাকরি থেকে ইস্তফা।
ইস্তফার পরই তার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। অভিযোগ রয়েছে, ফ্যাসিস্ট আমলের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্যতার সুযোগে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে আফতাবনগর জহুরুল ইসলাম সিটি সোস্যাইটির নির্বাচনে তিনি ব্যাপক কারচুপি করেন। নিজে প্রচার সম্পাদক পদে জয়ী হওয়ার পাশাপাশি নিজের পুরো প্যানেলকেও একচেটিয়া জয়ী করেন। সে সময় নির্বাচনটি নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ওঠে।
প্রতিদ্বন্দ্বী ইঞ্জিনিয়ার কামাল প্যানেলের পরাজিত অনেক প্রার্থী অভিযোগ করেন—গুম ও পুলিশি নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে কারচুপি করা হয়; তারা ভয়ে মুখ খুলতে পারেননি। প্রায় সমান ব্যবধানে সবাইকে হারানো হয়—এমন অভিযোগও রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সিজনের শক্তির উৎস ছিল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও-এর বিশেষ আশীর্বাদ।
সূত্র বলছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাদের অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচারের বিষয়েও তার সম্পৃক্ততা ছিল। কিন্তু এমডির সঙ্গে বিশেষ সখ্যতার কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি।
সিটি ব্যাংকের নিলাম হওয়া একটি টয়োটা হ্যারিয়ার গাড়ি তিনি নিজেই কিনে ব্যবহার করছেন—এমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগও রয়েছে। তবু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নীরব ছিল।
সম্প্রতি বনানী শাখার নারী সহকর্মীর সম্মানহানির ঘটনায় মানবসম্পদ বিভাগ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। এ বিষয়ে এমডির নীরবতা সিজনকে ব্যথিত করলে তিনি ধৃষ্টতা দেখিয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। জানা গেছে, এমডির ইশারায় সেই ইস্তফা এখনো গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে বলেও মানবসম্পদ বিভাগ জানিয়েছে। সিজন নিজেও ‘ব্যাড লাক’ মন্তব্য করে ঘটনার সত্যতা আড়াল করেননি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সিজন জানান, তিনি নড়াইলের ছাত্রজীবনে প্রথমে শিবিরকর্মী ছিলেন, পরে ছাত্রদলের নেতা। বিভিন্ন প্রশ্নে তিনি কখনো স্বীকারোক্তি, কখনো এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে উত্তর দেন। প্লট, ফ্ল্যাট এবং ৫২ লাখ টাকা দিয়ে হ্যারিয়ার গাড়ি কেনা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন—সবই লোন নিয়ে করেছেন। পরে আবার কাস্টমারের কাছ থেকে ব্যাংকের রিকভারি গাড়ি নিজে কেনার কথাও স্বীকার করেন।
জানা গেছে, কাস্টমারকে দিয়ে ব্যাংকের নিলাম স্থগিত করিয়ে তিনি ৫২ লাখ টাকা দিয়ে গাড়িটি ক্রয় করেন—যা সরাসরি ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’।
একই বছরে দুটি প্রমোশন পাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে বিষয়টি ঘুরিয়ে ব্যাখ্যা দেন। আফতাবনগর সোসাইটির ভোট কারচুপির প্রশ্নে প্রতিপক্ষ প্যানেলকেই ফ্যাসিস্ট বলে আখ্যা দেন।
বনানী শাখায় সহকর্মীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘টিমের একজনকে বকেছি। বিজনেসের জন্য বকা তো দিতেই হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংক তার সঙ্গে এমন আচরণ করেছে যে মনে হয়েছে ইস্তফা দিলেই ভালো।’ শেষে তিনি জানান, প্রতিবেদকের সঙ্গে সরাসরি বসে ‘অনেক কষ্টের কথা বলবেন।’
এদিকে অভিযোগ রয়েছে, সিজনকে রক্ষা করতে সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন ব্যাংকের জনসংযোগ শাখার কর্মকর্তাদের ওপর চাপ দিচ্ছেন।
Sangbad Bela’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।



























মন্তব্য