প্রচ্ছদ / জাতীয় / বিস্তারিত

রাজনীতির সীমা ছাড়িয়ে কোটি মানুষের দোয়ায় বেগম জিয়া

২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:০১:৫৮

ফাইল ছবি

এবার রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের হৃদযন্ত্রের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (সিসিইউ) বর্তমানে দেশের কোটি মানুষের আবেগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। গত ২৩ নভেম্বর থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখানে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকদের মতে, ৮০ বছর বয়সী এই প্রবীণ রাজনীতিবিদের শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত জটিল। গত কয়েকদিন ধরে তা ‘স্থিতিশীল’ হলেও যেকোনো মুহূর্তে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার শঙ্কা পুরোপুরি কাটেনি।

এই গভীর সংকটের মধ্যেই সোমবার (১ ডিসেম্বর) দুপুরে চীন থেকে পাঁচজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের একটি দল ঢাকায় এসে এভারকেয়ার হাসপাতালে বেগম জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেছে। লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্র এবং এখন চীন, বিশ্বের নানা প্রান্তের চিকিৎসকদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করে তার চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালের চার দেয়ালের ভেতরের এই চিকিৎসা তৎপরতার বাইরে যে দৃশ্য গত কদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। দল-মত নির্বিশেষে মানুষের এমন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং ভালোবাসা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে আর কোনো রাজনীতিবিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।

এদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ‘গণতন্ত্রের মা’ খ্যাতি পাওয়া বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ আনুষঙ্গিক লজিস্টিক সাপোর্ট প্রস্তুত থাকলেও, তার শারীরিক অবস্থার অস্থিতিশীলতার কারণে বিমানে তোলার মতো ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা গেছে। বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে যে নাটকীয় এবং উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে গভীর প্রভাব ফেলেছে। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে জানা গেছে, তার লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, এবং কিডনি জটিলতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, দীর্ঘ সময়ের জন্য তার বিমানে ভ্রমণ বা কেবিন প্রেশারের তারতম্য সহ্য করা প্রায় অসম্ভব।

দীর্ঘ সময় ধরে সুচিকিৎসা না পাওয়া এবং কারাগারে থাকাকালীন তার স্বাস্থ্যের যে অবনতি হয়েছে, আজকের এই সংকটময় মুহূর্তটি তারই দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল। চীন থেকে আসা বিশেষজ্ঞ দল এবং এর আগে জনস হপকিন্স বা লন্ডনের চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়া হলেও, মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার শরীরের রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনের স্থিতিশীলতা। এভারকেয়ারের চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন তাকে কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে, যাতে তাকে বিমানে তোলার ঝুঁকিটা নেওয়া যায়। প্রতিটি ঘণ্টা এখন তার পরিবারের সদস্য, দলের নেতাকর্মী এবং চিকিৎসকদের জন্য এক একটি পাহাড়সম অপেক্ষার মতো মনে হচ্ছে।

এরই মধ্যে সোমবার দুপুরের দিকে হঠাৎ করেই রাজধানীসহ সারা দেশে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন অনির্ভরযোগ্য সূত্র এবং বেনামি অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হয়েছে এবং তাকে সিসিইউ থেকে এভারকেয়ারের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করে ‘লাইফ সাপোর্ট’ দেওয়া হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে এই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এতে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র হাহাকার ও উৎকণ্ঠা জাগে। হাসপাতালের সামনে অপেক্ষমাণ জনতা এবং সংবাদকর্মীদের মধ্যে এক অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়।

বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ যখন তুঙ্গে, তখন ‘সিসিইউ’, ‘লাইফ সাপোর্ট’ এবং ‘ভেন্টিলেশন’ এই শব্দগুলো নিয়ে জনমনে চরম বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক তৈরি হয়। সন্ধ্যা নাগাদ বিভিন্ন মহলে জোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ‘ভেন্টিলেশনে’ রাখা হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই শব্দগুলোর মধ্যে যে সূক্ষ্ম কিন্তু বিশাল পার্থক্য রয়েছে, তা না বোঝার কারণে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন।

করোনারি কেয়ার ইউনিট বা সিসিইউ হলো হাসপাতালের এমন একটি বিশেষায়িত বিভাগ, যা মূলত হৃদরোগে আক্রান্ত বা হার্টের জটিলতা আছে এমন রোগীদের জন্য। বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছেন, তাই তাকে সিসিইউতে রাখা হয়েছে যাতে তার হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ এবং হার্টের কার্যকারিতা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা যায়। এখানে রোগী সাধারণত সজ্ঞান থাকেন এবং নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস নিজেই নিতে পারেন।

অন্যদিকে ‘লাইফ সাপোর্ট’ বলতে নির্দিষ্ট একটি মেশিনকে বোঝালেও চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটি একটি ব্যাপক প্রক্রিয়া। যখন কোনো রোগীর শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ (যেমন হার্ট, কিডনি বা ফুসফুস) স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তখন কৃত্রিম উপায়ে সেই অঙ্গের কাজ চালিয়ে নেওয়াকে লাইফ সাপোর্ট বলা হয়। এতে ওষুধের মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা থেকে শুরু করে ডায়ালাইসিস বা কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস, সবই হতে পারে। অর্থাৎ, লাইফ সাপোর্ট মানেই রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত নয়, বরং এটি রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার একটি সাময়িক সহায়তা ব্যবস্থা।

সোমবার দুপুর থেকে একবার শোনা যাচ্ছে বেগম জিয়া ‘লাইফ সাপোর্টে’, আরেকবার ‘ভেন্টিলেশনে’ আছেন। মেডিকেল বোর্ডের ঘনিষ্ঠ সূত্র মতে, তার শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে তাকে হয়তো সাময়িক অক্সিজেন সহায়তা (অক্সিজেন সাপোর্ট) দেওয়া হচ্ছে, যা সিসিইউতে চিকিৎসার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে দলের মিডিয়া সেল থেকে তাৎক্ষণিক জানানো হয়, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ছাড়া অন্য কারও বক্তব্য বা সামাজিক মাধ্যমের গুজবে কান দেওয়া যাবে না। একমাত্র ডা. জাহিদই বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ এবং সঠিক খবর জানাবেন, অন্য কোনো সূত্র নির্ভরযোগ্য নয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের গুজব ছড়ানোর পেছনে মানুষের অত্যধিক আবেগ এবং তথ্যের ঘাটতি যেমন কাজ করেছে, তেমনই কোনো কোনো মহলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাও থাকতে পারে। গুজবের এই ডালপালা ছাঁটতে এবং নেতাকর্মীদের আশ্বস্ত করতে দলের সিনিয়র নেতারাও তাৎক্ষণিকভাবে মাঠে নামেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী চেয়ারপারসনের সুস্থতা কামনায় আয়োজিত এক দোয়া মাহফিলে অংশ নিয়ে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে সিসিইউতেই আছেন, তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়নি। আগে যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল, গতকাল ও গত পরশু যেমন ছিল, আজও তেমনভাবেই সেই চিকিৎসা চলছে। এর বাইরে আর কোনো নতুন আপডেট নেই। অন্য যে যা-ই বলুক, এতে কেউ যেন বিভ্রান্ত না হয়।’

রিজভী আহমেদ আরও সতর্ক করে বলেন, ‘একটি মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছে, তাই ডা. জাহিদের ব্রিফিং ছাড়া অন্য কোনো তথ্যে বিশ্বাস করা যাবে না।’ অন্যদিকে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় একই তথ্য দেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘ম্যাডামের অবস্থা স্থিতিশীল আছে। ডাক্তারদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে তার চিকিৎসা চলছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ম্যাডামকে নিয়ে যে সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে (লাইফ সাপোর্টের বিষয়), সেটা সঠিক নয়। কেউ এতে বিভ্রান্ত হবেন না।’

দলের শীর্ষ নেতাদের এই তড়িৎ হস্তক্ষেপ এবং পরিষ্কার বার্তা সাধারণ মানুষের উদ্বেগ কিছুটা প্রশমিত করলেও, উৎকণ্ঠা পুরোপুরি কাটেনি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই ঘটনা প্রমাণ করে বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে জনমনে কতটা স্পর্শকাতরতা বিরাজ করছে।

Sangbad Bela’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মন্তব্য