মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

৩১ জুলাই ২০২৫, ১:৩৮:৪৬

এক বছর আগে শেখ হাসিনার সরকারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে গঠিত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনও মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি। বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটি বলছে, শেখ হাসিনার শাসনের সময় যেসব ভয় ও নির্যাতন ছিল, তার অনেকটাই কমেছে। তবে ড. ইউনূসের সরকার এখনও বিরোধীদের আটক করছে এবং মানবাধিকার রক্ষায় বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।

এদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর এশিয়া বিভাগের উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, শেখ হাসিনার দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে যারা এক বছর আগে জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাদের অধিকারভিত্তিক গণতন্ত্রের স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি। তিনি বলেন, ড. ইউনূসের সরকার যেন এক ধরনের অচলাবস্থায় পড়েছে। সংস্কারবিহীন নিরাপত্তা বাহিনী কখনো সহিংস ধর্মীয় চরমপন্থি আবার কখনো প্রতিশোধপরায়ণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতেই যেন ব্যস্ত।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে ২০২৪ সালে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো নানা সুপারিশ দিলেও, এখনো সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বলে উল্লেখ করেছে এইচআরডব্লিউ। সংস্থাটি বলছে, সরকার এখনো কঠিন সংকটে আছে। এর মধ্যে রয়েছে গণপিটুনি, রাজনৈতিক সহিংসতা, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, ধর্মীয় চরমপন্থিদের হাতে নারী ও এলজিবিটিকিউ জনগোষ্ঠীর ওপর হুমকি।

এইচআরডব্লিউ এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৪টি বাড়ি ভাঙচুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামেও সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন চালানো হয়। শেখ হাসিনার সরকারের সময়কার দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১৪০০ জন নিহত হওয়ার পর তিনি ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন। এরপর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। কিন্তু নির্যাতন, হেফাজতে মৃত্যু এবং বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড এখনো বন্ধ হয়নি। বরং নিরাপত্তা খাতে সংস্কারের প্রয়োজন আরও স্পষ্ট হয়েছে বলে জানায় এইচআরডব্লিউ।

১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে ‘ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি’র এক সমাবেশে সংঘর্ষে ৫ জন নিহত হন। এরপর পুলিশ ৮৪০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে, যাদের বেশিরভাগের নামও জানানো হয়নি। ৬ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৯২৪৮৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। প্রায় ৪০০ সাবেক এমপি ও মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। এইচআরডব্লিউ এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৬৮টি হত্যা মামলা রয়েছে, যার অনেকগুলো ঘটেছে যখন তিনি বিদেশে ছিলেন। অধিকাংশ মামলায় এখনো চার্জশিট হয়নি।

বহু রাজনৈতিক নেতার অভিযোগ, তাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন মামলা দেওয়া হয়েছে। তাদের জামিন ও চিকিৎসাও আটকে রাখা হচ্ছে। এইচআরডব্লিউ বলছে, তার অনুপস্থিতিতেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হচ্ছে ৩ আগস্ট। তবে অনেক মামলায় এখনো কোনো প্রমাণই উপস্থাপন করা হয়নি।সরকার পুরনো ‘স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট’ ব্যবহার করে শত শত মানুষকে গ্রেফতার করছে। ফেব্রুয়ারির অপারেশন ডেভিল হান্টে ৮৬০০ জনকে আটক করা হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধেও বিচারপ্রক্রিয়া খুবই সীমিত। এখন পর্যন্ত মাত্র ৬০ পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যদিও অভিযানে বহু ইউনিট জড়িত ছিল, যার মধ্যে দুর্নাম কুড়ানো র্যাবও রয়েছে।

২৭ আগস্ট সরকার গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন করে এবং আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ সনদে সই করে। কমিশনের মতে, তারা এখন পর্যন্ত ১৮০০ অভিযোগ পেয়েছে, কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনী প্রমাণ নষ্ট করছে এবং সহায়তা করছে না। পুলিশ, বিচারব্যবস্থা ও নারী অধিকার নিয়ে ১১টি সংস্কার কমিশন সুপারিশ করলেও এখনো কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির চেষ্টাও এগোয়নি।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৩২৫ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী, নারীদের সমান ও নিরাপদ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ধরপাকড় বন্ধ, র্যাব বিলুপ্তি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা বাহিনীর জবাবদিহি এবং নারীর অধিকার নিশ্চিত করার সুপারিশ জানায়। সংস্থাটি বলেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন অন্তর্বর্তী সরকারকে সাহায্য করে, কিন্তু যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করে।

Sangbad Bela’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মন্তব্য