চীনকে পাশে টানার চেষ্টা মোদির

২৪ মার্চ ২০২৫, ৬:৪৪:৫৫

সংগৃহীত

চীন-ভারত সম্পর্কে টানাপড়েন দীর্ঘদিনের। ২০২০ সালে উত্তর লাদাখে দুই দেশের মধ্যকার সীমান্ত সংঘর্ষের পর থেকে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। সেসব পেছনে ফেলে চার বছর পর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে নজর দিচ্ছে ভারত। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক নিয়ে ইতিবাচক কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ভারত-চীন সীমান্তে স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। পাশাপাশি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার আহ্বানও জানিয়েছেন মোদি।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী কথার প্রশংসা করে বলেছেন, “দুই দেশের অংশীদার হওয়া উচিত এমন, যা একে অপরের সাফল্যে অবদান রাখে”। ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্বের জন্য মোদির বক্তব্য দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নতির জন্য যতটা বড় পদক্ষেপ মনে করা হচ্ছে, বাস্তবতা আসলে তেমন নয়। দুই দেশের সম্পর্কে টানাটানি এখনো রয়েই গেছে। এই সম্পর্ক আরো উন্নত করতে এবং সত্যিকারের সম্প্রীতি উপভোগ করার জন্য, দ্বিপাক্ষিক-ভাবে এবং আরও বিস্তৃত ভূ-রাজনৈতিকভাবে দেশ দুইটির অনেক ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে।

ভারত-চীন সম্পর্কের অনেক উজ্জ্বল ক্ষেত্র রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ধারাবাহিকভাবে শক্তিশালী করা। লাদাখ সংঘর্ষের পরও ভারতের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার চীন। তারা প্রধান উন্নয়নশীল দেশের জোট ব্রিকস থেকে শুরু করে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক পর্যন্ত, বহুপাক্ষিকভাবে একে অপরকে সহযোগিতা করছে।

এমনকি লাদাখ সংঘর্ষের পর কয়েক দশকের মধ্যে ভারত-চীন সম্পর্ক তলানিতে ঠেকলেও দেশ দুইটির সামরিক বাহিনী উচ্চ-স্তরের সংলাপ চালিয়েছে। যার ফলস্বরূপ গত অক্টোবরে সীমান্ত টহল পুনরায় শুরু করার বিষয়ে একটি চুক্তি হয়েছে। একই মাসে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে দেখা করেন মোদি। তখন আরও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন দুই নেতা। পরে জানুয়ারিতে উভয় পক্ষ সরাসরি ফ্লাইট পুনরায় চালু করতে সম্মত হয়।

তারপরও দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে অশান্তি লেগেই আছে। উভয় পক্ষ অপরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথেও ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারত এবং পাকিস্তানের সাথে চীনের বেশ ভালো সম্পর্ক।

চীন বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলে ভারতীয় নীতির বিরোধিতা করে। বেইজিং পারমাণবিক সরবরাহকারী গ্রুপের মতো প্রভাবশালী গোষ্ঠীতে সদস্যপদ এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ পাওয়ার রাস্তা অবরুদ্ধ করে ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে একের পর এক হতাশায় পরিণত করেছে। এছাড়া ভারতের বৃহত্তর সামুদ্রিক পেছনে চীনের নৌবাহিনীর উপস্থিতি এবং তাদের একমাত্র বিদেশী সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।

এদিকে ভারত তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক গভীরতর করছে, যেটিকে চীন একটি ধর্মত্যাগী প্রদেশ হিসেবে দেখে। দেশটি তিব্বতের নির্বাসিত নেতা দালাই লামাকেও হোস্ট করে। বেইজিং তাকে বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে বিবেচনা করে। ভারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজ্যগুলিতে সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির বিষয়ে আলোচনা করছে, যা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা উস্কানি রোধ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। চীন বেশ কয়েকটি বৈশ্বিক ফোরামের মাধ্যমে এটিকে প্রতিহত করার প্রচেষ্টা করছে।

সম্পর্ক উন্নত করতে দেশ দুইটি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম সীমান্ত আলোচনা। দুই হাজার ১০০ মাইল দীর্ঘ সীমান্তের পঞ্চাশ হাজার বর্গমাইলে বিতর্ক রয়েছে, যা গ্রীসের আয়তনের সমান। সীমান্তের পরিস্থিতিই চীন-ভারত সম্পর্কের সবচেয়ে বড়বাঁধা। লাদাখ সংঘর্ষের পর একে অপরের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছিল উভয় দেশ। গত বছরের টহল চুক্তি এই বিশ্বাস পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেছে। দুইপক্ষ যদি আরও বেশি আস্থা তৈরি করতে পারে, তাহলে সম্পর্ক হয়তো ভালো হতে পারে।

ভবিষ্যৎ উচ্চ-স্তরের যোগাযোগও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যদি নরেন্দ্র মোদি এবং শি জিনপিং, দুজনেই ব্যক্তিগত কূটনীতির যোগাযোগ বাড়িয়ে দেন, তবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সাম্প্রতিক গতি আরও শক্তিশালী হবে। আগামী জুলাইয়ে ব্রিকস, নভেম্বরে জি২০ এবং এই বছরের শেষের দিকে সাংহাই কো-অপারেশন গ্রুপ (এসসিও) এর সম্মেলনের ফাঁকে শীর্ষ নেতাদের মিলিত হওয়ার সুযোগ থাকবে। চীন-ভারত এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে সম্পর্কের গ্রাফ অবশ্যই ঊর্ধ্বমুখী হবে। 

সম্পর্ক উন্নয়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চীনা বিনিয়োগ। এটি ভারতীয় শিল্পের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যা পুঁজি উৎপাদন থেকে নবায়নযোগ্য পর্যন্ত চীনের সাথে ভারতের ৮৫ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সাহায্য করবে। এই ধরনের বিনিয়োগের বৃদ্ধি ভারতকে একটি সময়োপযোগী অর্থনৈতিক উন্নতি এনে দেবে। পাশাপাশি চীনকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল প্রধান অর্থনীতিতেও সুবিধা দেবে। শক্তিশালী বাণিজ্যিক সহযোগিতা, দুই দেশের তীব্র উত্তেজনা কমিয়ে রাখতে আরও অনুপ্রাণিত করবে।

ভারতের চারটি প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কায় নতুন নেতারা দায়িত্ব নিয়েছেন। এসব নেতারা দেশগুলোর আগের নেতাদের থেকে আরও বেশি চীনপন্থি। তবে এখন পর্যন্ত তারা চীনের সাথে একপাক্ষিক নয়, বেইজিং এবং দিল্লির উভয়ের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। এভাবে চলতে থাকলে প্রতিবেশী দেশগুলোতে বেইজিংয়ের প্রভাব নিয়ে দিল্লির উদ্বেগ কিছুটা কমতে পারে।

অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও চীন-ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় ফ্যাক্টর। ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার পরই চীনের উপর শুল্ক চাপিয়েছেন। একইসঙ্গে ভারতের উপরও শুল্ক বৃদ্ধির হুমকি দিয়েছেন। ট্রাম্প যদি এমনটা করেন তবে বেইজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্যিক সহযোগিতা জোরদার করতে মরিয়া হয়ে উঠবে ভারত। পাশাপাশি চীনের সাথে নিজস্ব সম্পর্ক আরও ভাল জায়গায় নিশ্চিত করতে চাইবে মোদির দেশ। কারণ দিল্লির শঙ্কা, ওয়াশিংটন চীনের মোকাবেলায় ভারতকে সহায়তা করতে ততটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নাও হতে পারে। 

এদিকে ভারত এবং চীন এশিয়ার দুটি বৃহত্তম দেশ এবং উভয়ই নিজেদেরকে গর্বিত সভ্যতা রাষ্ট্র হিসেবে দেখে। তারা স্বাভাবিকভাবেই একে অপরের প্রতিযোগী। তবে সম্পর্কের সাম্প্রতিক ইতিবাচক অগ্রগতি, অন্যান্য ফ্রন্টে দ্বিপাক্ষিক অগ্রগতির সম্ভাবনার এবং উভয়ের সম্পর্কে আরও স্থিতিশীলতা আনতে পারে। সূত্র : বিবিসি

Sangbad Bela’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মন্তব্য