বেড়েছে পানির দাম, আজ থেকেই কার্যকর

ঢাকা ওয়াসার পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আজ ১ জুলাই থেকে পানির নতুন দাম কার্যকর হতে যাচ্ছে। এই দফায় এক লাফে পানির দাম বাড়ছে ১০ শতাংশ। সেই অনুযায়ী প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম পড়বে ১৬ টাকা ৭০ পয়সা। আর বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য একই পরিমাণ পানির নতুন দাম পড়বে ৪৬ টাকা ২০ পয়সা। ঢাকা ওয়াসার এ সিদ্ধান্তে গ্রাহক পর্যায়ে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা গেছে।
সাধারণ গ্রাহকরা বলছেন, বছরের অনেক সময়ই ঢাকার বিভিন্ন এলাকার মানুষ নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ পান না। যে ওয়াসা বছরের বিভিন্ন সময় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়, গ্রাহক সেবা নিশ্চিত না করে কেন তারা বারবার পানির দাম বাড়াবে? গত ১৬ বছরে ১৬ বার পানির দাম বাড়িয়েছে তারা। আর এই দাম বৃদ্ধির খড়্গ সরাসরি পড়ছে গ্রাহকদের কাঁধে।
অন্যদিকে, ঢাকা ওয়াসার দাবি, পরিচালনা ব্যয় এবং বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বর্তমান পানির দামে ওয়াসার পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং ডিএসএল পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই ঋণের টাকা পরিশোধ এবং ব্যয় ভার বহন করতেই পানির এই মূল্য বৃদ্ধি।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ওয়াসা আইন ১৯৯৬ এর ২২ ধারা অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয় করার লক্ষ্যে ১ জুলাই থেকে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ টাকা ৭০ পয়সা, যার দাম বর্তমানে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। আর বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য একই পরিমাণ পানির নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৬ টাকা ২০ পয়সা, যা বর্তমানে ৪২ টাকা।
এক লাফে ১০ শতাংশ পানির দাম বৃদ্ধির বিষয়টি মেনে নিতে চাইছেন না সাধারণ গ্রাহকরা। অযৌক্তিকভাবে গ্রাহকের কাঁধের ওপর বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
পানির দাম বৃদ্ধি বিষয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা ও একটি বাড়ির মালিক সিরাজুল ইসলাম বলেন, বছরে অনেক সময় আছে, যে সময় আমরা ঠিকমতো পানি পাই না। দিনের পর দিন ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে পানি সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়, তাদের কাছে অভিযোগ দিলে তারা এর সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। শুধু বলে পুরো ঢাকা শহরে পানি সরবরাহ ঠিক আছে, কিছু কিছু এলাকায় পানির সমস্যা হয়েছে।
তিনি বলেন, দিনের পর দিন আমরা পানি ছাড়া থেকেছি, সর্বশেষ গত রমজান মাসেও টানা কিছুদিন ওয়াসার পানি সরবরাহ ছিল না। তীব্র গরমেও বিভিন্ন সময় আমরা পানি সরবরাহ পাইনি। বারবার তাদের ফোন করা হয়েছে ও অভিযোগ জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ তারা নেয়নি। অথচ মাস শেষে ওয়াসার বিল ঠিকই দিতে হয়েছে। গ্রাহকদের এমন সমস্যা সমাধান না করে প্রতি বছর তারা পানির দাম বাড়িয়েই চলেছে। গণমাধ্যমে দেখেছি এবারও তারা পানির দাম বাড়াবে, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। একেবারে এক লাফে তারা ১০ শতাংশ পানির দাম বাড়াচ্ছে। বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তারা যদি গ্রাহক পর্যায়ে সেবার মান ঠিক করে পানির দাম বাড়ানোর কথা বলত, তাহলে হয়তো মেনে নেওয়া যেত। সাধারণ গ্রাহক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে অযৌক্তিকভাবে গ্রাহকের কাঁধের ওপর তারা দাম বৃদ্ধির বিষয়টি চাপিয়ে দিচ্ছে।
রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকার চ ১৫৯ নম্বর বাড়ির একজন ভাড়াটিয়া বেসরকারি চাকরিজীবী কবির আহমেদ বলেন, হুটহাট যখন ইচ্ছা ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। দাম বৃদ্ধির এই খড়গ এসে পড়ছে আমাদের মত সাধারণ ভাড়াটিয়াদের কাঁধে। তিন-চার বছর আগেও বাসা ভাড়ার সঙ্গে ৫০০ টাকা পানির বিল পরিশোধ করতাম। পরে তা বেড়ে ৭০০ টাকা, সর্বশেষ এখন প্রতিমাসে এক হাজার টাকা করে পানির বিল দিচ্ছি বাসা মালিকের হাতে। এখন আবার শুনছি আগামী ১ জুলাই থেকে আরেক দফা পানির দাম ১০ শতাংশ বাড়িয়ে দিচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। এখন বাসার মালিক তো ভাড়াটিয়াদের কাঁধেও আরেক দফা পানির মূল্য বৃদ্ধির নোটিশ ধরিয়ে দেবে। তখন থেকে হয়তো আমাদের আরও বেশি পানির দাম পরিশোধ করতে হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে আবার যদি আরেক দফা পানির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়, সেই চাপ এসে আমাদের কাঁধে পড়ে। এতে করে সংসার খরচে টান পড়ে। কোনোভাবেই চাই না ঢাকা ওয়াসা আবারো পানির দাম বৃদ্ধি করুক।
এদিকে ঢাকা ওয়াসার দাবি, গ্রাহক যে দামে বর্তমানে পানি পাচ্ছে তার চেয়ে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। ভর্তুকি দেওয়ার মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে পানি দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি এক হাজার লিটার পানিতে ঢাকা ওয়াসাকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে প্রায় ১০ টাকা। মূলত ভর্তুকি কমাতেই পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ওয়াসা আইন ১৯৯৬ এর ২২ (২) ধারা অনুযায়ী ওয়াসা বোর্ড প্রতিবছর পানি ও পয়ঃঅভিকর সমন্বয় করতে পারে।
এর আগেও বিভিন্ন সময় পানির দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে সমালোচনার মুখে পড়ে ঢাকা ওয়াসা। নানামুখী সমালোচনার পর ওয়াসার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পানির দাম সমন্বয় ওয়াসার একটি রুটিন প্রক্রিয়া। ঢাকা ওয়াসা আইন অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে পানির দাম আংশিক সমন্বয় করে মাত্র। পানির দাম বাড়ানো-কমানোর ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে ওয়াসা আইন, ১৯৬৬ মোতাবেক ওয়াসা বোর্ডের। নগরবাসীর সুষ্ঠু টেকসই ও উন্নত গ্রাহক সেবা প্রদানের স্বার্থে ঢাকা ওয়াসা প্রতিবছরই এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। সবশেষ ২০২১ সালে পানির দাম বাড়িয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।
আইন অনুযায়ী, প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়াতে পারে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। তবে, সেক্ষেত্রে ঢাকা ওয়াসার বোর্ড সভায় অনুমোদন পেতে হয় বিষয়টি। আর এর চেয়ে বেশি পানির দাম বাড়াতে হলে অনুমোদন নিতে হয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে। তবে, অভিযোগ রয়েছে, এবার ১০ শতাংশ পানির দাম বৃদ্ধির বিষয়টি ঢাকা ওয়াসার বোর্ড সভায় তোলা হয়নি।
পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের দাবি, পরিচালনা ব্যয় এবং বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান পানির দামে ওয়াসার পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং ডিএসএল পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ঋণের টাকা পরিশোধ এবং ব্যয় ভার বহন করতে পানির বিশেষ মূল্য বৃদ্ধি প্রয়োজন।
ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক উত্তম কুমার রায় বলেন, এ কথা ঠিক আমাদের চাহিদার তুলনায় প্রোডাকশন ক্ষমতা বেশি। তবে, আমাদের সবার সচেতনতা প্রয়োজন, সবাই সচেতন হলে এলাকাভিত্তিক যেসব সাময়িক সমস্যা আছে পানির, সেগুলো আর থাকবে না। আমরা নিয়মিত গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের অভিমত শুনে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
পানির দাম বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা চাই না ওয়াসা ক্ষতিগ্রস্ত হোক। এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, এটাকে যদি আমরা আর্থিকভাবে সাবলম্বী ও সচ্ছল করতে না পারি, তাহলে আর সেবার মান থাকবে না। সব বিষয় বিবেচনা করে সামান্য কিছু পানির দাম বাড়ানো হচ্ছে। গ্রাহকদের কথা বিবেচনা করে ২০২১ সালের পর থেকে কিন্তু ঢাকা ওয়াসা পানির দামে সমন্বয় করেনি। এবার এসে দাম সমন্বয় করার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
পানির দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা ওয়াসা গ্রাহকদের ওপর অযৌক্তিকভাবে দাম চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এমনিতেই অন্যান্য ওয়াসার চেয়ে ঢাকা ওয়াসা পানির দাম বেশি নিচ্ছে। এরপর আবার দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনা অযৌক্তিক। বিদেশি ঋণের কথা উল্লেখ করে পানির দাম তারা বাড়াতে চাচ্ছে। এ অবস্থায় একটি বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে যে, বিদেশি ঋণের টাকায় ঢাকা ওয়াসার নেওয়া প্রকল্পে জনগণ কতটা সুবিধা ভোগ করছে। না-কি তারা দাম বাড়িয়ে তাদের ঋণের চাপ জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে?
এদিকে, পানির মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। দুর্নীতি, অপচয় ও অব্যবস্থাপনা রোধ করলে পানির মূল্য বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হবে না বলে মনে করছে সংগঠনটি।
ক্যাবের তথ্য কর্মকর্তা আনোয়ার পারভেজের সই করা এক লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মূল্যস্ফীতি এমনিতেই জনজীবনকে আর্থিকভাবে দারুণ চাপে ফেলেছে। মানুষ ভীষণ কষ্টে আছে। মূল্য সমন্বয়ের নামে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। একই কায়দায় ঢাকা ওয়াসাও পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্ধিত পানির দাম বহাল থাকলে জনমানুষের জীবনে দারুণতর আর্থিক কষ্টের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হবে। সেবার পরিবর্তে বাণিজ্যিক ধারায় প্রতিষ্ঠান চালিয়ে সরকারের কাছ থেকে একদিকে ভর্তুকি নেয়, অন্যদিকে কোম্পানির মুনাফা দেখিয়ে ঢাকা ওয়াসা যে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও লুণ্ঠনমূলক মুনাফার প্রক্রিয়া তৈরি করেছে, তা যেমন অগ্রহণযোগ্য, তেমনই জনস্বার্থের পরিপন্থি।
ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন: https://www.youtube.com/watch?v=Xg7-vNS9sRU
Sangbad Bela’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
সর্বশেষ
Office: Airport haji camp
Phone: +8801712856310 Email: sangbadbela@gmail.com
Developed by RL IT BD
মন্তব্য